Playlist 1981 Phil Collins - In The Air Tonight 1981 Foreigner - Waiting for a Girl Like You 1983 The Police - Every Breath You Take 1985 Robert Tepper - No Easy Way Out 1986 Kenny Loggins - Danger Zone 1987 Starship - Nothing Gonna Stop Us Now 1988 Belinda Carlisle - Heaven Is A Place On Earth 1987 U2 - With or Without You 1989 Phil Collins - Another Day In Paradise 1989 Elton Jhon - Sacrifices 1998 Modern Talking - You're My Heart, You're My Soul 2014 The Midnight - Gloria 2014 The Midnight - Los Angeles 2016 The Midnight - The Comeback Kid 2016 The Midnight - Sunset 2016 FM-84 - Running In The Night (feat. Ollie Wride) 2018 Thought Beings - Hazy 2018 The Midnight - Lost Boy 2018 Alex & Megan McDuffee - Avenger 2019 Fury Weekend - Thousand Lights (feat. Megan McDuffee) 2019 Ollie Wride - Back To Life 2014 The Midnight - Days of Thunder 2019 Kalax - Dream 2020 Nina - Automatic Call 1983 Tangerine Dream - Love on a Real Train (OST Risky Business)
হুমায়ূন আহমেদ - একা একা
(Eka Eka by Humayun Ahmed)
রাতদুপুরে দুম দুম করে দরজায় কিল পড়তে লাগল।
সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। আগুন-টাগুন লেগেছে কিংবা চোর এসেছে। চোর হবার
সম্ভাবনাই বেশি। খুব চুরি হচ্ছে চারদিকে।
আমরা দুজনের কেউই ঘুমাই নি। ঘর অন্ধকার করে বসে
আছি। বাবু ভাই তার শেষ সিগারেটটি ধরিয়েছে। সিগারেট হাতে থাকলে সে কোনো কথাবার্তা
বলে না। কাজেই আমি গম্ভীর গলায় বললাম, কে?
দরজা খোল।
বড় চাচার গলা। ধরা যেতে পারে সাংঘাতিক কিছু হয়
নি। এ বাড়িতে বড় চাচার কোনো অস্তিত্ব নেই। কাজকর্ম কিছু করেন না। সে জন্যই
তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে হৈচৈ করে বাড়ি মাথায় তোলেন। একবার রাত তিনটায় এমন
চেঁচামেচি শুরু করলেন যে পাহারাদার পুলিশ আমাদের গেটের কাছে বাঁশি বাজাতে লাগল।
আমি এবং বাবু ভাই দুজনে ছুটে গিয়ে দেখি ছোট
চাচির পোষা বিড়াল তার ঘরে ঢুকে বিছানার উপর বমি করছে। বড়
চাচার সে-কী চিৎকার। যেন ভয়ঙ্কর একটা কিছু হয়েছে।
আজ রাতেও নিশ্চয়ই সে-রকম কিছু হবে। হয়তো চাচির
বিড়াল তাঁর ঘরে গিয়ে কুকীর্তি করে এসেছে। আর এই নিয়ে ঘুমুবার সময়টায় তিনি
লাফঝাপ শুরু করেছেন। আমি বিরক্ত স্বরে বললাম, কী হয়েছে চাচা?
দরজা খুলতে বললাম—কানে যায় না?
ব্যাপারটা কী?
চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব, লাট সাহেব কোথাকার! দরজা খোল।
বাবু ভাই সিগারেট ফেলে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
রাতদুপরে কী শুরু করেছেন?
কী শুরু করেছি মানে? একটা মানুষ মারা যাচ্ছে।
কে মারা যাচ্ছে?
বড় চাচা তার উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড
একটা লাথি কষালেন দরজায়।
বাবু ভাই উঠে দরজা খুলল।
ঠাণ্ডা গলায় বলল, কে মারা যাচ্ছে?
বড় চাচা হুঙ্কার দিয়ে
বললেন, সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না। নিচে যা।
হয়েছেটা কী বলবেন তো?
বাবার অবস্থা বেশি ভালো না।
স্ট্রোক হয়েছে না কি? হতে
পারে। অবস্থা খুব সিরিয়াস। খুবই সিরিয়াস!
বড় চাচাকে দেখে মনে হলো না
তিনি খুব বিচলিত। বরঞ্চ এই উপলক্ষ্যে হৈচৈ করার সুযোগ পাওয়ায় তাকে বেশ খুশি
খুশিই মনে হলো। অনেক দিন পর একটা দায়িত্ব পেয়েছেন।
সবাইকে খবর দেয়া দরকার। নিঃশ্বাস
ফেলার সময় নাই এখন। উফ কী ঝামেলা!
তিনি ঝড়ের মতো নিচে নেমে
গেলেন। তার গলা অবশ্যি শোনা যেতে লাগল, ড্রাইভার কোথায়? ড্রাইভার? কাজের সময় সব
কোথায় যায়? পেয়েছে কী?
বারান্দার লাইট জ্বলল। চটি
ফটফট করে কে যেন নামল। ছোট চাচা? এ বাড়িতে ছোট চাচাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি চটি
পরেন এবং শব্দ করে হাঁটেন। নিশ্চয়ই তিনি।
বাবু ভাই আরেকটি সিগারেট
ধরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। চিন্তিত স্বরে বলল, তুই চট করে দেখে আয় সত্যি সত্যি
অবস্থা খারাপ কি না। আমার মনে হয় বাবা খামাখা চেঁচাচ্ছে।
নিচে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি
অবস্থা খারাপ।
দাদার ঘরে অনেক লোকজন। ছোট চাচা,
বড় চাচা, শাহানা, আমাদের ভাড়াটে রমিজ সাহেব। কম পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। তার
খাটটি সরিয়ে সিলিং ফ্যানের ঠিক নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। রাখা হয়েছে আধাশোয়া করে।
তিনি হাত দুটি ছড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার জন্য ছটফট করছেন। পৃথিবীতে এত অক্সিজেন
কিন্তু তার বৃদ্ধ ফুসফুসটাকে তিনি আর ভরাতে পারছেন না। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু
ঘাম।
শাহানা একটি হাতপাখা নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু সে ক্রমাগত পাখা নেড়ে যাচ্ছে। তার মুখ
হয়েছে পাংশুবর্ণ। লম্বাটে মুখ আরো লম্বা দেখাচ্ছে।
দাদা কী একটা বলতে চেষ্টা
করলেন। শ্লেষ্মা জড়িত স্বর, কিছুই বোঝা গেল না।
বড় চাচি চেয়ারে বসেছিলেন।
তিনি চোখ বড় করে বললেন, কী বলছেন রে?
কী জানি কী?
শাহানা, তুই কিছু বুঝতে পারলি?
জি-না মামি।
দাদা এবার স্পষ্ট বলে উঠলেন,
মিনু, ও মিনু।
মিনু আমাদের সবচে' বড় ফুপু।
ন’ বছর বয়সে গলায় কী একটা ঘা (খুব সম্ভব ক্যান্সার) হয়ে মারা গিয়েছিল। অল্প
বয়সে মৃত্যু হবে বলেই হয়তো রাজকন্যাদের মতো রূপ নিয়ে এসেছিল। আমাদের বসার ঘরে
এই ফুফুর একটি বাঁধানো ছবি আছে।
দাদা আবার বিড় বিড় করে কী
বললেন। তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল।
শাহানা আমার কাছে এসে ফিসফিস
করে বলল, বড় ভয় লাগছে।
ভয়ের কী আছে?
একটা মানুষ মরে
যাচ্ছে - এটা ভয়ের না, কী বলছিস তুই?
দাদা ছটফট করতে লাগলেন।
একজন মানুষ শ্বাস নেবার জন্য
প্রাণপণ চেষ্টা করছে আর আমরা এত সহজে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। আমার দাড়িয়ে থাকতে লজ্জাই
লাগল।
দাদা তাহলে সত্যি সত্যি মারা
যাচ্ছেন। ইদানীং তাঁর সাথে আমার খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হতো না। ঘরের পাশ দিয়ে
যাবার সময় তিনি ডাকতেন, কে যায়, বাবু? বাবু না? তাহলে কে, টগর? এই টগর, এই। আমি
না শোনার ভান করে দ্রুত বেরিয়ে যেতাম। কী কথা বলব তাঁর সাথে?
দাদার নিজের কোনো কথা নেই
বলার। আমারও নেই।
একজন বুড়ো মানুষ যার
স্মৃতিশক্তি নেই, গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, তার কাছে দীর্ঘ সময়
বসে থাকা যায় না। কিন্তু মানুষ শুধু কথা বলতে চায়। সর্বক্ষণ চায় কেউ না কেউ
থাকুক তার পাশে। কে থাকবে এত সময় তাঁর কাছে? দাদা তা বুঝেন না। তার ধারণা পৃথিবীর
সবারই তার মতো অখণ্ড অবসর। কাজেই তিনি কান খাড়া করে দরজার পাশে সারাদিন এবং
প্রায় সারারাত বসে থাকেন। কারোর পায়ের শব্দ পাওয়া গেলেই ডাকেন, কে যায়? কে
এটা, কথা বলে না যে, কে?
বাধ্য হয়ে কোনো কোনো দিন
যেতে হয় তার ঘরে। তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন, কে তুই? বাবু?
জি-না, আমি টগর।
তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
কখন পরীক্ষা কী পরীক্ষা কিছুই
তিনি জানেন না। কিন্তু সমস্ত কথাবার্তা তার পরীক্ষা দিয়ে শুরু হয়।
আমি ঝামেলা কমাবার জন্য বলি,
ভালোই
ডিভিশন থাকবে?
জি থাকবে।
অংক ভালো হয়েছে? অংকটাই আসল।
ডিভিশন হয় অংক আর ইংরেজিতে। ইংরেজি কেমন হয়েছে ?
ভালোই হয়েছে?
“আমি আসিতে আসিতে ট্রেন
ছাড়িয়া দিল'– এর ইংরেজি কী হবে বল দেখি ?
দাদার সঙ্গে কথা বলার এই
যন্ত্রণা। আমি এমএসসি করছি বোটানিতে, কিন্তু তার কাছে বসলেই একটা ইংরেজি ট্রানস্লেশন
করতে হবে। মাসখানেক আগে একবার বাবু ভাইকে ডেকে এনে পাটিগণিতের অংক করতে দিলেন। সে
অংক আবার পদ্যে লেখা— অর্ধেক পঙ্কে তার, তেহাই সলিলে। নবম ভাগের ভাগ শৈবালের
জলে...' ইত্যাদি।
বাবু ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
দাদা, আমি পাশটাশ করে ইন্ডেন্টিং-এর অফিস খুলেছি, এখন বসে বসে পাটিগণিত করব নাকি?
তুই আবার পাশ করলি কবে?
এমএ পাশ করলাম দুই বছর আগে।
বলিস কী? কোন ক্লাস পেয়েছিস?
আপনাকে নিয়ে তো মহা মুসিবত
দেখি।
দাদাকে নিয়ে মুসিবত শুরু
হয়েছে অনেক দিন থেকেই। বছর তিন ধরে হঠাৎ করে তার মাথায় গণ্ডগোল হতে শুরু করে।
ব্যাপারটা সাময়িক। দিন দশেক থাকে আবার সেরে যায়, আবার হয়। মস্তিষ্ক বিকৃতির
সময়টা ৰাড়িসুদ্ধ লোককে তিনি অস্থির করে রাখেন। এই সময় তিনি কিছুই খান না। ভাত
মাখাবার সময় তিনি নাকি দেখতে পান একটা কালো রঙের বিড়াল থাবা দিয়ে তার সঙ্গে ভাত
মাখছে। কাজেই তিনি ভাত খেতে পারেন না। একজনকে তখন প্লেট উঁচু করে রাখতে হয়, যাতে
বিড়ালে ভাত ছুঁতে না পারে। অন্য একজনকে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতে হয়। তুলে
দেয়া ভাতও বেশিক্ষণ খেতে পারেননা। দু'এক নলা মুখে তুলেই চেঁচাতে থাকেন—বিড়াল গা
বেয়ে উঠছে, গা বেয়ে উঠছে। চেঁচাতে চেঁচাতে এক সময় বমি করে ফেলেন। কী কষ্ট কী
কষ্ট!
অসুখের আগেও যে তার সময় খুব
ভালো যাচ্ছিল তা নয়। দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকতেন বারান্দায়। ইজিচেয়ারে আধশোয়া
হয়ে সমস্ত দিন একা একা পড়ে থাকা নিশ্চয়ই কষ্টকর ব্যাপার। ঠিক এই বয়সে এই
অবস্থায় একজন মানুষ কী ভাবে কে জানে? বসার ভঙ্গিটা অবশ্য অপেক্ষা করার ভঙ্গি। যেন
কোনো একটা কিছুর জন্য অপেক্ষা। সেটা নিশ্চয়ই মৃত্যু। বারান্দার অন্ধকার কোনায়
এককালের একজন প্রবল প্রতাপের মানুষ আধো জাগ্রত অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।
চিত্রটি অস্বস্তিকর।
এখন রাত এগারোটা পঁচিশ। দাদার
যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে এ জগতের জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান হতে বেশি দেরি নেই। তার
বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। জীবনের সর্বশেষ যাত্রাটি সুসহ করা হলো না কেন কে জানে?
আকবরের মা প্রকাণ্ড একটা
গামলা ভর্তি ফুটন্ত পানি এনে হাজির করল। বড় চাচি অবাক হয়ে বললেন, গরম পানি কী
জন্যে ?
আমি কী জানি? আমারে আনতে
কইছে, আনছি।
শাহানা, গরম পানির কথা কে
বলছে ?
আমি জানি না মামি।
কী যে এদের কাণ্ড। এই আকবরের
মা, পানি নিয়ে যাও তো। কে বলেছে তোমাকে পানির কথা?
বড় মিয়া কইছেন।
যাও নিয়ে যাও।
আকবরের মা পানি নিয়ে যেতে
গিয়ে ইচ্ছে করেই অর্ধেক পানি ফেলে ঘর ভাসিয়ে দিল। আমি দাদার ঘর থেকে বের হয়ে
এলাম। বারান্দার এক প্রান্তে উগ্র মূর্তিতে বড় চাচাকে দেখা গেল। তার সামনে কালাম।
কালামের মুখ পাংশু বর্ণ।
আজকে তোর চামড়া খুলে ফেলব। মানুষ
মারা যাচ্ছে বাড়িতে আর তোর আজকে না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে? লাট সাহেব আর কী।
আমাকে দেখে বড় চাচার কাজের
উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। কালামের গালে প্রকাণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। আমার দিকে
তাকিয়ে মেঘস্বরে বললেন, তোকে যে বললাম সবাইকে খবর দিতে, দিয়েছিস?
জি-না দেই নাই। দেব।
একটা কথা কতবার বলা লাগে?
যাচ্ছি।
যাচ্ছি কখন?
নিজের চোখে অবস্থাটা দেখছিস
না?
চাচা, ডাক্তার আনতে কেউ
গিয়েছে ?
রমিজ সাহেব গিয়েছেন। রমিজ
এলে তুই গাড়ি নিয়ে যাবি। বাবুকে সঙ্গে নিস। সেই মাতবরটা কোথায়?
উপরে আছে।
যা ডেকে নিয়ে আয়। অন্য
বাড়ির লোকজন ছোটাছুটি করছে, আর নিজেদের কারোর খোঁজ নেই । আফসোস!
অন্য বাড়ির অর্থাৎ রমিজ
সাহেব। লম্বা কালো মোটাসোটা একটা মানুষ যাদের দেখলেই মনে হয় এদের জন্ম হয়েছে
অভাব-অনটনে থাকবার জন্যে। তিনি আমাদের ভাড়াটে। একতলার চারটা কামরা নিয়ে আজ সাত
বছর ধরে। আছেন। এই সাত বছর কোনো ভাড়া বাড়ানো হয় নি। কিন্তু তবু রমিজ সাহেব তাঁর
নামমাত্র ভাড়াও নিয়মিত দিতে পারেন না। হাত কচলে চোখ-মুখে দীন একটা ভাব ফুটিয়ে
আমার বাবাকে গিয়ে বলেন, রহমান সাহেব, একটা বড় বিপদে পড়েছি- আমার ছোট শালির এক
ছেলে...
রমিজ সাহেবের বাড়ি ভাড়া না
দেয়ার কারণগুলি সাধারণত বিচিত্র হয়ে থাকে এবং তা শেষ পর্যন্ত শোনার ধৈর্য কারোর
থাকে না। বাবাকে এক সময় বিরক্ত হয়ে বলতে হয়, থাক থাক, একটু রেগুলার হবার চেষ্টা
করবেন বুঝলেন?
জি স্যার। আর দেরি হবে না।
রেগুলার হবার কোনোরকম চেষ্টা
অবশ্যি দেখা যায় না। তিনি নিজের অংশের একটা ঘর সাবলেট দিয়ে ফেলেন গোঁফওয়ালা
বেঁটে একটা লোককে। আমাদের অবশ্য বলেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিপদে পড়েছে, তাই দিন
দশেক থাকবে। সেই লোক মাস দুয়েক থাকার পর আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বড় চাচা
খুব রাগলেন। গলার রগ ফুলিয়ে বললেন, সব কটাকে ঘাড় ধরে বের করে দাও, ফাজলামি
পেয়েছে। বেঁটে লোকটা খুব হম্বিতম্বি শুরু করল, বললেই হয়! দেশে আইন-আদালত নাই ?
এভিকশন কি মুখের কথা? এতে বড় চাচা আরো বেশি রেগে গেলেন এবং হুকুম দিলেন বাড়ির সব
জিনিসপত্র বাইরে বের করে দিতে। আমাদের বাড়ির চাকর-বাকর অনেকদিন পর একটা উত্তেজনার
ব্যাপার ঘটাবার উপক্রম দেখে উৎসাহে সঙ্গে সঙ্গে আলনা, ট্রাঙ্ক, চেয়ার-টেবিল বাইরে
এনে ফেলতে লাগল। আমি হৈ চৈ শুনে বারান্দায় এসে দেখি রমিজ সাহেবের স্ত্রী
রক্তশূন্য মুখে দাড়িয়ে আছেন। অত্যন্ত বিশ্রী ব্যাপার। এই সময় বাবু ভাই এলো
কোথেকে এবং সে খুব অবাক হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এইসব কী?
আকবরের মা একগাল হেসে বলল,
বড় ভাই, এরারে বাড়ি থাইক্যা বাইর কইরা দিতেছি।
রমিজ সাহেবের বড় মেয়েটা
শব্দ করে ফুপিয়ে উঠল। বাবু ভাই গম্ভীর মুখে বললেন, জিনিসপত্র সব ঘরে নিয়ে ঢুকাও।
এইসব কী ?
বড় চাচা কী একটা বলতে
যাচ্ছিলেন। বাবু ভাই তার আগেই এগিয়ে এসে কালামের গালে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে
দিলেন। কালাম হৃষ্টচিত্তে একটা মিটসেফ ঠেলাঠেলি করে আনছিল। সে কিছুই বুঝতে না পেরে
মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। বাবু ভাই যেন কিছুই হয় নি
এমনভাবে নিজের ঘরে চলে এলেন।
সেদিন আমি বেশ কিছু জিনিস
প্রথমবারের মতন লক্ষ করলাম। যেমন— রমিজ সাহেবের চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। রমিজ সাহেব
এবং তাঁর স্ত্রীর চেহারা মোটামুটি ধরনের কিন্তু তাদের চারটি মেয়েই দেখতে চমৎকার।
সবচেয়ে বড়টির (যার নাম নীলু) এমন মায়াকাড়া চেহারা। সবক’টি বোনের মধ্যে একটা
অন্যরকম স্নিগ্ধ ভাব আছে। তাছাড়া বাচ্চাগুলি এমনিতেও শান্ত। চিৎকার চেঁচামেচি কখনো
শুনেছি বলে মনে পড়ল না। এর কিছুদিন পরই রমিজ সাহেব হাসিমুখে এক প্যাকেট লাডডু
হাতে দোতলায় এলেন। বড় মেয়েটি তার পেছনে। ব্যাপার কী? বড় মেয়ে যার নাম নীলু সে
ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। রমিজ সাহেব সবক'টি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললেন,
ঘরের কাজকর্ম করে সময়ই পায় না। সময় পেলে স্যার আরো ভালো হতো।
বাবা অবাক হয়েই বললেন, কত
টাকার বৃত্তি?
মাসে চল্লিশ টাকা স্যার। আর
বই কিনা বাবদ দুইশ টাকা।
বাহ বেশ তো।
মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন
স্যার।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
দোতলা থেকে তারা রওনা হলো তিন
তলায়। এই সময় দেখা হলো আমার সঙ্গে।
এই যে ভাই সাহেব, আমার এই
মেয়েটা...
শুনেছি, বাবাকে বলছিলেন। আমি
বারান্দায় ছিলাম। খুব ভালো খবর।
নীলু, কদমবুসি কর টগর
সাহেবকে।
আমি আঁৎকে উঠলাম, আরে না না।
না কী ? মুরুব্বির দোয়া
ছাড়া কিছু হয় না কি ? এ্যা?
রমিজ সাহেব ঘর ঝাপিয়ে হাসতে
লাগলেন। আজ আর তিনি দীন ভাড়াটে নন। আজ একজন অহঙ্কারী বাবা। আমি বললাম, তোমার নাম
কী?
নীলু।
রমিজ সাহেব গর্জে উঠলেন, ভালো
নাম বল।
নীলাঞ্জনা।
বাহ সুন্দর নাম ।
রমিজ সাহেব হৃষ্টচিত্তে
বললেন, ওর মা'র রাখা নাম। আমি নাম দিয়েছিলাম জোবেদা খানম, সেটা তার মায়ের পছন্দ
হলো না। নামটা নাকি পুরনো। আরে ভাই আমি নিজেও তো পুরনো। হা-হা-হা!
বাবা মেয়েটির জন্য একটা
পার্কার কলাম কিনে পাঠিয়ে দিলেন। সেই কলমের প্রসঙ্গ রমিজ সাহেব সময়ে অসময়ে
কতবার যে তোলেন তার ঠিক নেই। যেমন দিন সাতেক পর রমিজ সাহেবের সঙ্গে নিউমার্কেটে
দেখা হলো। তিনি এক গাল হেসে বললেন, কাও শুনেছেন নাকি ভাই?
কী কাণ্ড?
পার্কার কলমটা যে দিয়েছেন
আপনারা, নীলু স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাশ ছুটি হওয়ার পর আর পায় না। মেয়ে তো
কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসছে। আমি দিলাম এক চড়। মেজাজ কি ঠিক থাকে বলেন আপনি? শেষে
তার ব্যাগের মধ্যে পাওয়া গেল। দেখেন অবস্থা। হা-হা-হা!
নীলুর সঙ্গে আমার খানিকটা
খাতিরও হলো অন্য একটি কারণে। একদিন দেখলাম দুপুরের কড়া রোদে সায়েন্স
ল্যাবরেটরিতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একা নয়, সঙ্গে আরো কয়েকটি মেয়ে। স্কুল
ড্রেস পরা থাকলে যা হয়- সবক'টাকে অবিকল এক রকম লাগে। তবুও
এর মধ্যে নীলুকে চিনতে পারলাম।
এ্যাই নীলু! নীলু হকচকিয়ে
এগিয়ে এলো।
যাচ্ছ কোথায় ? এ লাইনে তো
মিরপুরের বাস যায়।
কল্যাণপুর যাচ্ছি। আমাদের এক
বন্ধুর আজ গায়ে হলুদ, আমাদের যেতে বলেছে।
ঐ ওরাও যাচ্ছে তোমার সাথে ?
জি।
উঠে পড় গাড়িতে। পেীছে দেই।
যে ভিড়, এখন আর বাসে উঠতে পারবেনা।
নীলু ইতস্তত করতে লাগল। যেন
আমার শাথে দেখা হওয়ায় মস্ত অপরাধ করেছে। অন্য মেয়েগুলি অবশ্য হৈচৈ করে গাড়িতে উঠে
পড়ল।
তারা খুব খুশি।
সারাদিন থাকবে তোমরা?
নীলু জবাব দিল না। কালো মতো
একটি মেয়ে হাসিমুখে বলল, আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সবাই বাসায় বলে এসেছি। শুধু
নীলু ৰলে আসে নি।
কেন নীলু, বলে আস নি কেন ?
নীলু তারও জবাব দিল না। মাথা
নিচু করে বসে রইল। কালো মেয়েটি বলল, নীলু তার মা'র সঙ্গে ঝগড়া করেছে। দু'দিন ধরে
ওদের মধ্যে কথা বন্ধ।
তাই বুঝি ?
সবক'টি মেয়ে খিলখিল করে হেসে
ফেলল। ব্যাক ভিউ মিররে দেখলাম নীলুর চোখে জল এসে যাচ্ছে।
সন্ধ্যার পর নীলুদের বাসায়
সত্যি সত্যি দারুণ অবস্থা। রমিজ সাহেব কাঁদো হয়ে বাবু ভাইকে গিয়ে বললেন, ভাইসাব
শুনেছেন, আমার মেয়েটা কিডন্যাপ হয়েছে।
কী বলছেন এইসব?
জি ভাইসাব, সত্যি কথাই বলছি।
রমিজ সাহেব ভেউ ভেউ করে কেঁদে
ফেললেন। আমি বললাম, এসে পড়বে, হয়তো বন্ধুর বাড়িটাড়ি গিয়েছে।
আমার মেয়ে না বলে কোথাও যাবে
না টগর সাহেব।
নীলু সে-রাতে বাড়ি এসে পৌছে
রাত পৌনে আটটায়। ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে মুরুবি কিসিমের এক ভদ্রলোক এসে পৌঁছে দিয়ে
গেলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের নিচতলায় প্রলয়ের মতো হয়ে গেল। রমিজ সাহেব কেঁদে
গিয়ে পড়লেন আমার বড় চাচার কাছে। বড় চাচা একটা কাজ পেয়ে লাফঝাপ দিতে শুরু
করলেন— এই থানায় টেলিফোন করছেন, ঐ করছেন হাসপাতালে। একবার শুনলাম অত্যন্ত গভীর
ভঙ্গিতে কাকে যেন বলছেন, আরে ভাই, বলতে গেলে বাসার সামনে থেকে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে
গেছে। এই দেশে বাস করা অসম্ভব।
Comments
Post a Comment